Advertisement

মানভঞ্জন | দেবাশীষ



-:মানভঞ্জন :-
দেবাশীষ  

- বাবু একটা বেলুন এনে দেবেন বাবু ... এনে দিন না আমাকে যে রাগ ভাঙাতে হবে...
- অরে হটট! কথা থেকে যে আসে সব পাগল-ছাগলের দল ..রাত-দুপুরে মেজাজ তা একেই খারাপ তার উপর আবার এসব... বলতে বলতে রগে গজগজ করতে করতে চলে যাই লোকটা।

ফুটপাথে পড়ে থাকে করুন চোখে তাকিয়ে থাকা উস্কোখুস্কো একটা পাগল।
চোখটা বুজে আসছে কি... আসছে বোধহয়...

বছর পনেরো আগের কথা। ...
স্কুলের প্রথম দিন...ক্লাসে ঢুকেই চোখ চলে যায় ফার্স্ট বেঞ্চে বসে থাকা ঝুঁটিবাঁধা মেয়েটার দিকে। সাদা জামা নীল ফ্রক,কালো কুচকুচে দুটো চঞ্চল চোখ,বাঁ গালে একটা তিল,আর মুখ ভর্তি খিলখিলে হাসি..
না,না Love at First sight ভেবে ফেলবেন না যেনো । তখন তো বয়স সবে নয় কি দশ। তখনের সেই সরল মনে এত জটিল চিন্তা আসেনি।
অতঃপর চারটে ক্লাস শেষে টিফিনের ঘন্টা পড়ল।ইতিমধ্যেই গোটাকতক বন্ধুও হয়ে গেছে.....

— ওই!আমার নাম নন্দন।
তোর নাম কিরে?
—রাই।
—আমার বন্ধু হবি??
—হ্যাঁ হতে পারি,তবে আমাকে কুরকুরে খাওয়াতে হবে।
—কিন্তু আমার কাছে তো তিন টাকা আছে
—আচ্ছা আমার কাছে দু-টাকা আছে। মোট পাঁচ টাকা, হয়ে যাবে.....চল কিনে আনি, দুজনে মিলে ভাগ করে খাবো।
গল্পটার শুরু এখান থেকেই.......
তারপর সেই ক্লাস সেভেন....

—শুধুমাত্র তোর জন্যে নন্দন....তোর জন্যে আমাকে প্রথমবার কান ধরে দাঁড়াতে হল।
—কি!! বল তোর জন্যে আমাকে কান ধরে দাঁড়াতে হল....তুই কেনো অতো চেঁচামেচি করছিলি??
— তুই কেনো আমাকে চক ছুঁড়ে মারলি....
— বেশ করেছি!!
— তাহলে আমিও বেশ করেছি,হুঁ......
তারপর সেবার সেই মাধ্যমিক পরীক্ষার পর যখন একসাথে মেলা দেখতে গিয়েছিল....

— এই,শোন না.... একটা বেলুন কিনে দিবি আমায়....
— ওই শোন ন্যাকামি করবি না একদম, বেলুন নিয়ে খেলার বয়স আর নেই তোর
— তার থেকে ভালো ফুচকা খাবি তো বল...
—তুই না খুব পচা। চল ফুচকাই খাওয়াবি চল....
—চল...পেটুক কোথাকার....

তারপর, উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টের পর যখন আনন্দে এসে জড়িয়ে ধরেছিল রাই.....

— কিরে তুই!! এতো ভালো রেজাল্ট করেছিস...তাও মুখ গোমড়া করে বসে আছিস!!!!আমি কিন্তু আমার বিরিয়ানি বুঝে নেবো....
কিরে কি হয়েছে? শরীর খারাপ???
— না রে!
— তাহলে কি? আজকের দিনে মুখ গোমড়া
— আরে দূর!!কি হবে রেজাল্ট ভালো করে???জানিস তো সবই....সেই ছোটোবেলায় বাবা-মা ছেড়ে চলে গেছে....নেহাত মা মরার সময় খুব করে বলে গিয়েছিল তাই মামাবাড়িতে একটু মাথাগোঁজার জায়গা পেয়েছিলাম...এখন মামার ছেলের রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। তাই বলছে আর পয়সা দিতে পারবেনা....
— আরে চিন্তা করছিস কেনো? আমি তো আছি নাকি...
— দ্যাখ! আমি আগেও বলেছি আমি তোর থেকে টাকা নিতে পারবনা
— জানি ভায়া...তোমার self-respect নামক বস্তুটি বড্ড বেশি.......আমি বাবার সাথে কথা বলেছি। কাল থেকে আমার বোন আর পাশের বাড়ির ভাইটাকে পড়াতে যাবি....তাতেই তোর মাসখরচা চলে যাবে।
— তুই এত ভাবিস আমার কথা!
— আমি ভাবব না তো কে ভাববে শুনি........ওসব বাদ দে.. আগে আমার বিরিয়ানিটা খাওয়াবি চল
— তোর না....সারাদিন শুধু খাই খাই..

তারপর শেষ সেই বছর চারেক আগের রাত্রি......

এমনিতেই কয়েকদিন ধরে ঝগড়া চলছে.....কারণটা অবশ্য বিশেষ কিছু নয়...এমনিই টুকটাক... তাই আজ মিটমাট করার কথা....কিন্তু না আজকেও মিটমাট করতে পারল না...কথার মাঝেই রেগেমেগে উঠে চলে গেল নন্দন...

— শোন যাসনা.... পুরোটা শোন...দাঁড়া.....
কিন্তু কে শোনে কার কথা.....
আর সবথেকে বড়ো ভুলটা হল তখনই.....
মানুষরুপী নেকড়ের দল যে তার আশেপাশেই ঘোরাফেরা করছে, লোলুপ দৃষ্টিতে তার দিকেই যে তাকিয়ে আছে সেটা তখনও বুঝতে পারেনি রাই....

বেশ খানিকটা পথ চলে আসার পর নিজের ভুল বুঝতে পারে নন্দন...পাশ দিয়েই বেশ কিছু বেলুন নিয়ে যাচ্ছিল একটা ছেলে..তার কাছ থেকে কিনে নেয় সে, একটা বেলুন....তার প্রিয়তমার জন্যে মানভঞ্জনের প্রধান অস্ত্র....

কিন্তু সেখানে ফেরার পর পায় শুধু একটা নগ্ন দেহ,জ্বলন্ত অবস্থায়.....

না অনেক চেষ্টা করেও বাঁচাতে পারেনি সে...তাকেও উদ্ধার করা হয় অর্ধদগ্ধ অবস্থায়....কিন্তু প্রাণটা কোনোরকমে বেঁচে গেলেও ধাক্কাটা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি নন্দন...

ক্রমশ সকাল হয়...দোকানপাট খুলতে থাকে শহরের নিত্যদিনের কাজগুলো ঝেঁকে ধরে শহরটাকে......

হঠাৎ দেখা যায়

ফুটপাতে একটা পাগল বেলুন হাতে ছুটছে...পিছনে ছুটছে আরো দুটো লোক...

পাগলটা নেমে পড়ে রাস্তায়....রাস্তার দুপাশে ভিড় জমে যায়... একটা বাস এসে ধাক্কা মারে.... ছিটকে যায় পাগলটা, উল্টে পড়ে রাস্তার উপর....চারিদিকে রক্তের ছিটেতে ভরে ওঠে....

পুলিশ আসে, বডি সোজা করা হয়......
কিন্তু একী!! পাগলটার মুখভর্তি হাসি কেনো ??

হাসিটা হয়তো আনন্দের,দুঃখ-জ্বালা মেটার আনন্দের....

হয়তো দেখা হবে বছর চারেক পর,
থামবে এবার হয়তো অভিমানের ঝড়....
চাঁদের দেশে মিলবে তারা,বসবে তারাদের মেলা
এমনি করেই এবার শুরু হবে মানভঞ্জনের খেলা.......

ব্যাকগ্রাউন্ডে বেজে উঠবে........ 'পিয়া তোরা ক্যায়সা অভিমান...........'

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ